Lifestyle

আমরা কিভাবে শব্দ দূষণ রোধ করতে পারি: শব্দ সন্ত্রাসকে না বলি

মানুষ হিসেবে আমরা সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে পরিবার নিয়ে আমরা বসবাস করি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমরা একে অপরের সঙ্গে মিশি, কথা বলি, তথ্যের আদান প্রদান করি। এমনকি সত্য ও মিথ্যার প্রচার করি। উচ্চ আওয়াজ বা বিকট শব্দের মাধ্যমে শব্দ দূষণ করে মানবসমাজে শব্দ দূষণ ছড়াই। এর সাথে সাথে মানসিক যাতনা বৃদ্ধি করি, অযথা অকারণে মানুষকে কষ্ট দিই। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্মেও মানুষকে কষ্ট দিতে বারণ করা হয়েছে।

শব্দ দূষণ বলতে আসলে কী বোঝায়?

আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে পারি; উইকিপিডিয়ার সাহায্যে। চলুন তবে জেনে নিই, শব্দ দূষণ কী?

উইকিপিডিয়ার ভাষ্য মতে – “শব্দ দূষণ হলো, মানুষের বা কোনো প্রাণীর শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দ সৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বোঝায়। যানজট, কলকারখানা থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী এরকম তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়। মানুষ সাধারণত ২০-২০,০০০ হার্জের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। তাই মানুষের জন্য শব্দদূষণ প্রকৃতপক্ষে এই সীমার মধ্যেই তীব্রতর শব্দ দ্বারাই হয়ে থাকে। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন জোরালো এবং অপ্রয়োজনীয় শব্দ মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটানো এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করাই শব্দ দূষণ”।

কিভাবে শব্দ দূষণ হচ্ছে?

মাইক বা লাউডস্পীকারের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ। প্রয়োজনীয় ঘোষণা প্রদান। নির্বাচনী প্রচারণা ও ধর্মীয় জনসমাবেশের প্রচার ইত্যাদি কাজে আমরা সাধারণত লাউড স্পিকার ব্যবহার করি। আমাদেরকে পথে ঘাটে দোকানে বাজার হাটে ; এমনকি অফিস আদালত, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, কল কারখানা ফ্যাক্টরি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও উচু আওয়াজ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।

বিভিন্ন গণসমাবেশে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে হয়। কথা বলতে হয়। শুনতে হয়। আলোচনা ও বক্তব্য রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়। এসবের প্রায় জায়গাতেই আমরা উচ্চ আওয়াজের সাহায্য নিয়ে থাকি। এ ছাড়া বিভিন্ন সভা সমাবেশ মিটিং মিছিল ও ধর্মীয় জনসমাবেশগুলোতেও আমাদেরকে কথা বলার প্রয়োজনে লাউড স্পিকার ব্যবহার করতে হয়। প্রয়োজন থেকেই আমরা এ জাতীয় আয়োজনে লাউড স্পিকার ব্যবহার করি। কিন্তু এর মাধ্যমে যে আমরা শব্দ দূষণ করে নিজেরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি ক’জনই বা সেটি ভাবে?

অযথা, অপ্রয়োজনে গাড়ির ড্রাইভাররাও হর্ণ বাজিয়ে শব্দ দূষণ ছড়াচ্ছেন। হাসপাতাল, বিদ্যালয় ইত্যাদি জায়গায় হর্ণ বাজানো নিষেধ হলেও; কেউ কিন্তু মানছেন না এ বিষয়টি।
শিল্প নগরী সমৃদ্ধ শহর নগরে কলকারখানা থেকে কী পরিমাণ শব্দ দূষণ হয়, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য যতদিন পর্যন্ত আমাদের মিল ফ্যাক্টরি ও কলকারখানার জন্য আলাদা জনমানবহীন এলাকা নির্বাচন না করা হচ্ছে, ততদিন আমাদেরকে শব্দ দূষণের মতো ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতেই হবে। রেহাই নেই এ থেকে কারও!

বিয়ে বাড়িতে, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সভা সমাবেশ সেমিনারেও আমরা অযথা বাড়তি লাউড স্পিকার ব্যবহার করছি। বিকট আওয়াজে দূষিত করছি, গ্রাম-শহরের পরিবেশ। প্রকম্পিত হচ্ছে মাটি। টিনশেড বাসা বাড়ি কেঁপে ওঠে এ সময় প্রচন্ড শব্দ দূষণের প্রবল গতিতে।

এ সময় শিশু সন্তান ও বয়োবৃদ্ধ অনেক মানুষ কী পরিমাণ কষ্ট সয়ে, নির্ঘুম সময় পার করেন। তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। বোঝার কথাও নয়।

এজন্য জনসভা ও লোকসমাগম বেষ্টনীর মধ্যে আওয়াজকে সীমিত করা খুবই জরুরি। যাতে করে বাইরে অবস্থানরত এমন অসুস্থ এবং শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের কষ্ট লাঘব হবে। শব্দ দূষণের মতো যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে সর্বসাধারণ। আমরা পাব বসবাস যোগ্য একটি নীরব নির্মল পরিবেশ।

হর্ণ কিংবা ভেঁপু বাজিয়েও শব্দ দূষণ তৈরি করা হচ্ছে। কোলাহল, হইচইপূর্ণ সমাগম থেকেও হচ্ছে এই শব্দ দূষণ। এখানে উদাহরণত আমরা কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করেছি। এ ছাড়াও আরও নানা কারণে শব্দ দূষণ হতে পারে।

আমরা এখান থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় জানতে পেরেছি, তা হলো-
শব্দদূষণ মানেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন।

হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক! শব্দ দূষণের ফলে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। গত ২৬ এপ্রিল পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শব্দসচেতনতা দিবস। এ দিবসটিতে “শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক”। এমন একটি বারতা পৌঁছে গেছে আমাদের সবার মুঠোফোনে। কিন্তু কোনো সচেতনতা তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে? হবে বলে মনে হয়?

রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক জনাব বজলুর রশিদ তার এক গবেষণায় বিভিন্ন জরিপ ও প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরেছেন-

‘রাজধানী ঢাকায় ৭১ শতাংশ লোক শব্দ দূষণ হতাশায় ভোগেন। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন বলছে – বাংলাদেশ শব্দ দূষণের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। শব্দ দূষণের প্রভাবে বাড়ছে, খিটখিটে মেজাজের লোকসংখ্যা। বৃদ্ধি পাচ্ছে মানসিক অশান্তি রোগীর সংখ্যা। এ ছাড়া কাজে অমনোযোগী, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া এবং বধিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণও হচ্ছে এ শব্দ দূষণ’।

মোট কথা, একটি জাতিকে অকর্মন্য ও হতাশায় নিমজ্জিত করতে শব্দ দূষণও ভূমিকা পালন করে আসছে। যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনসংখ্যায় সংকট তৈরির পথে অন্যতম প্রধান কারণও বটে।

তাই আসুন, আমরা শব্দ দূষণ প্রতিরোধে সচেতন হই। সকলকে যত্রতত্র শব্দ দূষণ করা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করি। জনসচেতনতা তৈরি করি। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ। তাই আসুন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করি। শব্দ দূষণ রোধে ভূমিকা পালন করে সুন্দর ও সুস্থ দেশ জাতি গঠনে অংশীদার হই। আমাদের সমাজ হোক শব্দ দূষণ মুক্ত সুন্দর বসবাসের উপযোগী একটি পরিবেশ।

শব্দ দূষণের মাত্রা কত?

সাধারণত আমরা স্বাভাবিক ভাবে যে কথোপকোথন করি তার তীব্রতার স্তর ৪০ ডেসিবেল। এখন দেখা যাক বাসা বাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল কিংবা বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দের তীব্রতা কত-

  • হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের ১০০ মিটার পর্যন্ত রাতে ৪০ এবং দিনে ৫০ ডেসিমেল। এই জায়গাগুলোকে নিরব এলাকা ধরা হয়।
  • আবাসিক এলাকায় অর্থাৎ মানুষ বসবাস করে এমন এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা থাকবে ৪৫ ডেসিবেল।
  • আবাসিক এলাকায় দিনের অন্যান্য সময়ে এই মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এর বেশি অতিক্রম করতে পারবে না।
  • বাণিজ্যিক এলাকায় রাত ও দিনে যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।

আরও পড়ুন: ধূমপান ছাড়ার কার্যকর কৌশল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button