কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ বই রিভিউ: Book Review
যিনি আমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন, যিনি দান করে চলেছেন অবারিত নিয়ামত তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার থেকে; সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রবের। দরুদ এবং সালাম প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি, আসমানি আলোয় যিনি আলোকিত করেছেন গোটা সৃষ্টিলোক। যিনি বহন করেছেন নূর এবং তাতে সমুজ্জ্বল হয়েছে অন্ধকারে ঢেকে থাকা হৃদয়গুলো।
বুক রিভিউ: ০৭
বইয়ের নামঃ কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ
লেখকঃ আরিফ আজাদ
বইটি লেখা হয়েছে কুরআনে স্থান পাওয়া বিভিন্নি ঘটনাবলি ও তা থেকে আমরা কিভাবে শিক্ষা নিতে পারি। যে জ্ঞান আমাদের ব্যক্তি জীবন আরো সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের যে মেসেজগুলো দিয়েছেন তা সর্বক্ষেত্রে হয়তো আমরা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারিনা। এই বইয়ে আলোচনা করা ঘটনা বা আয়াতগুলো সম্পর্কে অন্তত ভালো জ্ঞান পাওয়া যাবে।
বইটি পড়তে শুরু করার আগে ভেবেছিলাম অনেক বেশি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যার তুলনায় খুব বেশি কুরআনের ঘটনা বা আয়াত নিয়ে আলোচনা না পেয়ে শেষ করার সময় কিছুটা হতাশ হয়েছি।
তবে আরিফ আজাদ স্যারের লেখা বইয়ে যে আলাদা ব্যাপার থাকে তার ধারাবাহিকতা এই বইয়েও রয়েছে। বইটি পড়তে বসলে আল্লাহ ও আল্লাহর সৃষ্টিকূল ও সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য কি সেই ভাবনাগুলো আপনার মনের আনাচে কানাচে বিস্তার করতে সহায়তা করবে। জীবনের বেলা শেষে, সোনার তোরণ পানে টপিকগুলো আপনাকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিবে বলে বিশ্বাস করি। বইটি থেকে সামান্য দুটি অংশ নিচে তুলে ধরা হলোঃ
জীবনের বেলা শেষে
চলুন, একান্ত অবসরে বসে আমরা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি দৃশ্যটা। দুনিয়াতে আমি যে ভালো কাজগুলো করেছি, হোক তা কম কিংবা বেশি, আসমানের নির্দিষ্ট একটা দরোজা দিয়ে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। এই নির্দিষ্ট দরোজাটা কেবল আমার একার – আর কারও না। শুধু তো আমল নয়, আমার জন্য যে রিযক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নির্ধারণ করেছেন, তা-ও আসমানের ওই দরোজা দিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। ঐ দরোজাটা আমাকে চিনে, আমার নাম জানে।
আমি যখন ভালো আমল করি, মানুষের বিপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাই, মানুষের সাথে ভালো আচরণ করি, আমি যখন অশ্লীলতাকে পরিহার করে চলি, যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নাযিলকৃত বিধানকে আমি নিজের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিই—আসমানের সেই দরোজা তখন খুশি হয়ে যায়। হয়তো-বা ঠিক সেরকম, যেরকম আমাদের ভালো ফলাফলে, ভালো অর্জনে খুশি হয়ে পড়েন আমাদের বাবা-মা।
আমরা বিপথে গেলে, অসৎ সঙ্গ আর অনিয়মের বেড়াজালে আটকে গেলে আমাদের বাবা-মা’রা যেভাবে ব্যথিত হন, ঠিক সেভাবে আমরা যখন গুনাহ করি, মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ি, যখন আল্লাহর বিধানকে ছেড়ে আমরা পা বাড়াই কু-প্রবৃত্তির বাতলানো পথে, তখন কি আসমানের সেই দরোজা ব্যথিত হয় না? দুঃখ পায় না? আমাদের ভালো কাজে, ভালো আমলে যদি সেটা আনন্দিত হয়, মন্দ কাজ আর মন্দ আমলে ব্যথিত হবে—সেটাই তো স্বাভাবিক।
সোনার তোরণ পানে (সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে)
এই অর্থ ধরে যদি আমরা সূরা আসরের প্রথম দুই আয়াতকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে খুব চমৎকার একটা ব্যাপার আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, وَالْعَصْرِ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ “শপথ এমন সময়ের, যা ক্রমাগত ফুরিয়ে যাচ্ছে! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।”(৪৮)
আচ্ছা, সময়ের সাথে মানুষের ক্ষতির কী সম্পর্ক? সময় বয়ে গেলে মানুষের ক্ষতি কীভাবে হয়? আদতে আমাদের জীবন সময়ের সমষ্টিমাত্র। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার অর্থই হলো ক্রমাগত আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া। সময় বয়ে যাচ্ছে; কিন্তু আমরা আমাদের চিরন্তন যে গন্তব্য, যেখানে আমাদের ঠাঁই হবে অনন্তকালের, আমাদের সেই অসীম যাত্রার ব্যাপারে আমরা চরম উদাসীন।
আমরা জানি আমাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত। এটা এক মহা ধ্রুব সত্য। কিন্তু এই মহাসত্য জেনেও আমরা এমনভাবে জীবনযাপন করি, যেন আমরা কখনোই মৃত্যুবরণ করবো না। আমাদের জীবনের দিকে তাকালে মনে হবে—যেন আমরা মৃত্যুকে জয় করে বসে আছি। আখিরাতের সম্বল গোছানোর কথা উঠলেই আমরা নিজেদের মনগড়া যুক্তি দিই এবং প্রবোধ গুণে বলি—‘জীবন তো কেবল শুরু। জীবন ও যৌবনের এই যৌথ আনন্দ থেকে এখনই যদি নিজেদের গুটিয়ে ফেলি জীবনকে উপভোগ করবো কখন?’
একজন মনীষীর একটা সুন্দর কথা আছে। তিনি বলেছেন, ‘সমস্যা হচ্ছে- আপনি মনে করছেন আপনার হাতে অনেক সময় আছে।’
আর এটাই খুব নির্জলা সত্য কথা। আমাদের অধিকাংশের ভাবনাটাই আসলে এমন। আমরা মনে করি আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে আমল-ইবাদাত করার জন্য, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য কিংবা কাজ করার জন্য। এই ভুল ভাবনার বাকশোতে বন্দী হয়ে আমরা পিছিয়ে দিই আমাদের চিন্তা, কাজ, আমল আর ইবাদাতকে। এই ‘করবো আর কী’—ভাবনাটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা।
এই যে সময়ের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতা, চরম উদাসীনতা—এ দুইয়ের মাঝেই আমাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়। আমরা না দুনিয়া অর্জন করতে পারি, না আখিরাতের সম্বল কাঁধে করে পাড়ি জমাতে পারি অনন্তের স্রোতে। বিভ্রান্তির দোলাচলে, প্রবৃত্তির মায়াজালে আটকা পড়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ‘সময়’ যাকে অবহেলা করেই কেটে যায় গোটা জীবন। কারও কারও নিভে যায় জীবন-প্রদীপ। সময়ের অসম ব্যবহারে, অগণন অপচয়ে আমরা যেভাবে বিভোর থাকি এর চেয়ে বড় ক্ষতি একটা মানব-জনমের জন্য আর কী হতে পারে?
এজন্যই সময়ের শপথের ঠিক পরেই মানবজীবনের মহা-ভুলটাকে মোটাদাগে তুলে এনেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। তিনি বলেছেন—মানুষ এক নিরস্তর ক্ষতির মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ বইয়ের লিংক
- যে আঁধারের রং নীল
- ভিষণ একলা দিনে