ট্রাক ড্রাইভার থেকে শিল্পপতী-খালেক পাঠান
আপনি কি জানেন কিভাবে স্বনামধন্য কেয়া কসমেটিক্স ব্রান্ডের উত্থান হয়েছিল? কার হাত ধরেই বা গড়ে উঠেছিল এতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান? জেনে অবাক হবেন যে, একজন ট্রাক ড্রাইভারের হাত ধরেই এত বড় একটি পতিষ্ঠানের গড়ে ওঠা।
“এই আর্টিকেলটি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোন পণ্য প্রমোট করার উদ্দেশ্যে লেখা নয়। আর্টিকেলটি লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তাদের মনোবল বাড়ানো।”
— আবাজ টিম
যেভাবে শুরু করলেন
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড কেয়া কসমেটিকস এর মালিক আব্দুল খালেক পাঠান। আপনি কি জানেন খালেক পাঠানের আজকের এই পর্যায়ে আসতে কত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে? রাস্তার পাশে বিস্কুট ও চকলেট আর বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করেন। সে যখন স্কুলের গন্ডিও পার হননি, তখন থেকেই তিনি টিফিনে টাকা থেকে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বিস্কুট ও চকলেট কিনে রাস্তার পাশে বসে খুব অল্প লাভে বিক্রি করতেন।
আরও বেশি লাভের জন্য তার কাছের বন্ধুর সাথে মুরগী কেনাবেঁচার ব্যবসা শুরু করেন। যেখানে কম দামে মুরগী কিনতে পারতেন সেখান থেকে কিনে দূরের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করা শুরু করলেন। এভাবে মুরগীর ব্যবসায় ভালোই লাভ হতে থাকে। এই লাভের টাকা খরচ না করে তা পুঁজি হিসেবে নতুন করে বিনিয়োগ করতেন। তার পরিবারের কেউ মুরগির ব্যবসা পছন্দ করত না, তাই যে বন্ধুর সাথে ভাগে মুরগীর ব্যবসা করতেন তার বাড়িতে মুরগী কিনে রাখতেন। একদিন মায়া কান্না দেখিয়ে বন্ধু বলল, তাদের সব মুরগী শেয়ালে খেয়ে গেছে। পাঠান সাহেবের আসল ঘটনা বুঝতে বাকি রইলো না। এখানেই মুরেগীর ব্যবসার ইতি ঘটালেন। তিনি কান্নায় ফেটে পড়লেন এবং ভাবলেন যে আমি আর ব্যবসায়ী হতে পারব না।
বিয়ের পর ভাগ্য বদল
ম্যাট্রিক পাস করলেন ১৯৭৮ সালে। ম্যাট্রিক পাস করার পরপর বিয়েও করে ফেললেন। বিয়ের পর স্ত্রীর কাছে থাকা ছয়শত টাকা নিয়ে রান্না করার লাকড়ির ব্যবসায় শুরু করলেন। এরপর ব্যবসা বাড়ানোর জন্য স্ত্রী তার গয়নাগুলোও তাকে দিয়ে ব্যবসায় ইনভেস্ট করতে বললেন। এই গয়না বেঁচে সেসময় হলো ৫০০০ টাকা যা দিয়ে মাছ চাষের জন্য একটা পুকুর ইজারা নিয়ে রুই মাছের পোনা ছাড়লেন। পুকুর থেকে এই মাছ বিক্রির জন্য প্রায় ৩ বছর লেগে যাবে বুঝতে পেরে এক বছর শেষ হতে না হতেই সব বেঁচে দিলেন।
ফিরে গেলেন লাকড়ির ব্যবসায় কিন্ত তাতেও সেই ব্যর্থতা। কিছুতেই যেন ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছিলেন না। তাই উপায়ন্ত না দেখে অন্যের কারখানায় মাসিক ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করলেন। কিন্তু বেশিদিন সেই চাকরিও করতে পারলেন না । কারণ টাকায় নেশায় অস্থির পাঠানের মাথায় যে কেবল ব্যবসার পোকা ঘুরপাক করে!
চুড়ান্ত সাফ্যল যেভাবে আসলো
চাকরি ছাড়ার পর একটা এনজিওতে অগ্রীম ৪০,০০০ টাকা দিয়ে সম্ভবত কিস্তিতে বাকী টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে একটা ট্রাক কিনে ফেললেন। নিজে চালাতে না পারায় একজন ড্রাইভারকে ট্রাক বুঝিয়ে দিলেন, আর হেলপার হেলপার হিসেবে নিজে তার সাথে থাকলেন। তার সাথে থেকে থেকে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে নিজেও মোটামুটি ট্রাকের ড্রািইভারী করা শিখে ফেললেন। ড্রাইভার দিনে ডিউটি করলে বাকি সময় অর্থাৎ রাতে খ্যাপ ঠিক করে নিজেই চলে যেতেন। এভাবে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তার হাতে ভালো পুঁজি হয়ে যায়।
একদিন ব্যাংকের এক কর্মকর্তা তাকে ইটের ভাটা করার পরামর্শ দেন এবং দরকার পড়লে ঋণ দেওয়ার আশ্বস্ত করেন। এই অফার পেয়ে ইট ভাটা করার জন্য জন্য জমি কিনলেন। ভাটা শুরু করার জন্য ব্যাংকের দারস্থ হলে ব্যাংক ঋণ দিলো না। খালেক পাঠান মহা বিপদে পড়ে গেলেন ।
এ পর্যায়ে শ্বশুর তাকে দুই লাখ টাকার ধার দিয়ে সহযোগিতা করলেন। পরের বছর সোনালী ব্যাংক তাকে আরও তিন লাখ টাকা ঋণ দিলো। ইট ভাটার শুরুটা ছিলো খুবই কঠিন তবে পরের সময়টা ছিল বেশ মশৃণ হয়েছিল। ইট ভাটার ব্যবসা ভালো হওয়ায় একে একে তিনি ৫টি ভাটার মালিক হয়ে গেলেন। এখান থেকে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার মতো ইট বিক্রি হতে লাগলো।
তারপর একসময় নিটিং ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করলেন, গেলেন ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য কিন্তু ব্যাংক ঋণ দেবে না । ব্যাংক কর্মকর্তা বললেন আপনিতো মাত্র মেট্রিক পাস, নিটিং ব্যবসা শতভাগ রপ্তানী মুখী। সেখানে সব সময় বাইরের বায়ারদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে হয় যা আপনার পক্ষে সম্ভব না। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন বিদেশী বায়ার আসবেন মালের কোয়ালিটি দেখতে, আমি ইংরেজি জানি কিনা সেটা দেখার জন্য না। তাছাড়া ইংরেজি বলা ও বোঝার মতো লোক তো আমার থাকবেই। এর পরেও ব্যাংক তাকে ঋণ দিলো না।
ব্যাংকের টাকা না পেয়ে নিজের টাকা জমিয়ে ভারত থেকে নিয়ে আসেন ১৮টি নিটিং মেশিন এবং কাজ শুরু করলেন পুরোদমে। এক সময় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝলেন এ লাইনে কাজ করার জন্য ইংরেজি কোন বাধা না। শুধু কোয়ালিটি প্রডাক্ট উৎপাদন করতে পারলেই সফল হওয়া যায়। এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সদয় হলেন, সবকিছু দেখে তাকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দিলেন। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শুরু হলো
কেয়া কসমেটিকস্ পণ্যের যাত্রা
এবার পাঠান সাহেবের নজর এলো কসমেটিকস পণ্যের দিকে। ১৯৯৬ সালে শুরু করলেন কেয়া কসমেটিক্স লিমিটেড এর যাত্রা। প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর কেয়া সোপ কেমিক্যালস ও কেয়া ডিটারজেন্ট লিমিটেডে এক হয়ে যায়। এর ৪ বছর পর ২০১৫ সালে আবার কেয়া কেয়া স্পিনিং, কেয়া কটন মিলস, কেয়া নিট কম্পোজিট কেয়া কসমেটিক্স লিমিটেড এর সাথে এক হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহৎ কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড। শুরু হয় বাংলাদেশের ব্যবসা জগতে আধিপত্য বিস্তার।
দেশের জন্য অবদান
খালেক পাঠানের ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রতিবছর রপ্তানি হয় প্রায় শত কোটি টাকার কাপড়। এই ইন্ডাস্ট্রিতে তিন হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। রপ্তানিতে বিশেষ অবদানের জন্য ৫ বার জাতীয় রপ্তানি পুরস্কার, ২ বার স্বর্ণপদক, ২ বার রৌপ্য ও ১ বার ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে।
খালেক পাঠানের ব্যবসার ইতিহাস থেকে অন্তত এটা প্রামাণ হয় যে, সততা ও পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই। তার সেই মুরগি ব্যবসায়ী বন্ধু কিন্তু এখনো কারখানার কর্মচারী রয়ে গেছেন। সব সময় মনে রাখতে হবে অন্যকে ঠকিয়ে কখনো বড় হওয়া যায় না।
এই আর্টিকেল শিক্ষণীয় দিক-
- পরিশ্রম ও লেগে থাকলে সাফল্য পাওয়া যায়।
- বাধা আসলেও দমে যাওয়া যাবে না।
- ইচ্ছা শক্তির কাছে পড়াশুনা কোন বাধা না।
- অন্যকে ঠকিয়ে কখনো বড় হওয়া যায় না।
সকল সাফল্য ও অনুপ্রেরণার গল্প এখানে দেখুন