Family Life

বিয়ে ভীতি : প্রতিকার কোন্ পথে?

ব্যক্তি জীবনের একাকিত্ব দূর করতে এবং পৃথিবীতে মানব প্রজন্মের বংশ বিস্তারের লক্ষ্যেই আমাদের বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ) থেকেই বৈবাহিক বন্ধনের সূচনা। যা হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে, গোত্রেও ফলো করা হচ্ছে।

আর সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের লক্ষ্যে ও পরিবার গঠনের জন্যই অচেনা দুজন নারী ও পুরুষের মাঝে বৈধ পন্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি রয়েছে। আর এটাই আমাদের সামাজিক রীতি ও প্রচলন। একজন পুরুষ একজন নারীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন ও তার দায়িত্বভার গ্রহণ ও ভরণ পোষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা এটাই ইসলামের শিক্ষা। যেমন সহি বুখারির বর্ণনায় এসেছে- হযরত উমর (রাঃ), রাসুল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন – হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো “একজন পুরুষ তার পরিবারের অভিভাবক। তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

জীবন ও জীবিকার তাগিদেই একজন পুরুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন। তার এ টাকা পয়সা উপার্জন, গাড়ি, বাড়ি সবকিছুই তার স্ত্রী সন্তান ও পরিবারের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য। একটু আরাম আয়েশে স্বচ্ছল জীবন যাপন করা। এইতো আমাদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য? না এর বাইরে বিশেষ আরও কিছু আছে বলে মনে হয়? নেই।

বর্তমানে বিয়েটা এত কঠিন করে ফেলেছি যে যুবক-যুবতী বিয়ের বয়সে পৌঁছানোর পরেও তারা নানাবিধ কারণে বিয়ে করতে পারছে না। ফলে পরিণত বয়সের যুবক-যুবতী যথাসময়ে বিয়ে করতে পারছে না বা পরিবার বিয়ে দিচ্ছে না। অর্থের অভাব, ক্যারিয়ার ডেভেলপ, উচ্চশিক্ষা অপূর্ণ, ভালো চাকরি বা ব্যবসাযয়ে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া প্রভৃতি অজুহাতে এই সমাজ বিয়েকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে যুবকরা যেমন বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারছে না। অপর দিকে উচ্চ শিক্ষা কিংবা জব ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটতে গিয়ে বিয়ের উপযুক্ত অনেক মেয়ে আজ বিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে চলছে। বিশ থেকে প্রায় ত্রিশ ছুঁই এমন মেয়ে আজ ঘরে ঘরে ভরে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রচন্ড বিয়ে ভীতি কাজ করছে।

একজন মানুষের জীবনে প্রচুর টাকা পয়সা ও অর্থ কড়ি কোনো কিছুর প্রয়োজন না থাকতে পারে। তবে নারী বা পুরুষ-উভয়ের জন্যই একজন জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন আছে। জীবনে চলার জন্য একজন মানুষ দরকার আছে। যে তার সুখ দুঃখের সঙ্গী হবে। সবসময় পাশে থাকবে। হাসি-কান্নার অংশীদার হবে। অবসর সময়ে গল্প করবে, পাশে থাকবে। এটাই জীবন। হোক তাতে সংগ্রাম। চলুক শত সংঘাত ও সংঘর্ষ। শুধু পয়সা কড়ি উপার্জন, ক্ষণিকের বন্ধু বান্ধবী নিয়ে বিনোদনে মেতে ওঠা এগুলো নিছক মরীচিকা। এসব ক্ষণিকের জন্য আনন্দ হতে পারে তবে তাও স্বার্থের জন্য। হেসে খেলে ঘুরে ফিরে দিন শেষ করা কোনো জীবন হতে পারে না! জীবনের অর্থও হতে পারে না।

আমাদের বিয়ের উপযুক্ত অসংখ্য যুবক যুবতীরা আজ বিয়ে ভীতি নিয়ে দিন পার করছে। হতাশা ডিপ্রেশন তাদের পিছু ছাড়ছে না। আজ বড়ো ব্যথিত হৃদয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে – বিয়ে ভীতি বেড়েই চলেছে আমাদের এই সমাজে। যুবক যুবতীরা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে ভয় পাচ্ছে। তারা সমাজের নানাবিধ অসামাজিক আচরণ, তালাক ডিভোর্স পরকীয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচার প্রসারের ফলে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে। বিবাহ বন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে তারা নেতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেছে। রাজধানী ঢাকায় ৪০ মিনিটে ১টি তালাক। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ জুন ২০২৩)। এসব সংবাদ পড়ার পর স্বভাবতই একজন যুবক যুবতীর মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে সম্মান শ্রদ্ধা ভক্তি না থাকায় তালাক ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। দাম্পত্য কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি তারা বলছেন, শিক্ষিত নারীরাই ডিভোর্সের শীর্ষে। এ ছাড়া শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, সংসারে অশান্তি; এসব কারণেও অনেক তরুণ তরুণী বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে।

দাম্পত্য জীবন থেকে দূরে সরে লিভটুগেদারকে বেছে নিচ্ছে, কেউবা বিভিন্ন জায়গায় ট্যূর দিয়ে। বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরে ফিরে মাস্তি করে জীবন যৌবন পার করে চলছে। এসবের মধ্যে আনন্দ বিনোদন খুঁজে ফিরছে। তবে এর ভেতরও অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। যে রহস্যের জট খোলা বড় মুশকিল। তারা মনে করছে এইতো জীবন। হেসে খেলে ফূর্তি করে শেষ হবে। এখানেই কী জীবনের শেষ?
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্ত্রীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন- ”তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। ১১ নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।” (সূরা রুম : ২১)

তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে – জীবনে কেউ কখনো সুখী হয় না, হবে না। ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ বিসর্জন দিয়েই চলতে হবে সংসার-জীবন নামের এ পথে। এটাই বাস্তব কথা। কষ্ট ক্লেশ, অশান্তি ও যাতনার মধ্য দিয়েই নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে হবে, মানতে হবে অনেক কিছু, এর নামই জীবন। এ হলো এক সংগ্রাম!
এর চেয়ে বড়ো কথা হলো, সে নারী বা পুরুষ যাই হোক প্রত্যেকেই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর প্রতি মুখাপেক্ষী। বিভিন্ন কারণে একজন আরেকজনের জন্য আবশ্যিক। এজন্য পবিত্র কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টাকে পোশাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ”তারা নারীরা তোমাদের পোশাক স্বরূপ, তোমরা পুরুষরা নারীদের জন্য পোশাক স্বরূপ।” (সূরা বাকারা: ১৮৭ নং আয়াতের অংশ বিশেষ)

পোশাক যেমন গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। জাপটে ধরে রাখে। ঠিক স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কটাও হওয়া চাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও ভালোবাসা পূর্ণ। এই গুণগুলোর অভাবেই আজ তালাক ডিভোর্স ও পরকীয়া বেড়ে চলছে।

একই ভাবে কুরআনের আরও একটি আয়াত আমাদেরকে এই নির্দেশনা প্রদান করে যে, মানুষের সৃষ্টিও জোড়া জোড়া করে। আল্লাহ বলেন- “আর তোমাদেরকে (নর ও নারীর) যুগল রূপে সৃষ্টি করেছি।” (সুরা নাবা: ০৮)

সুতরাং এখান থেকেও বোঝা যায়, কোনো মানুষই একাকী জীবন যাপন করতে পারে না। তার জন্য অবশ্যই জোড়া বা সঙ্গী একজন আছে।

ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী অর্জন করা একজন সনাতন যোগী তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন- ” আমি দেখেছি, যৌবনে যে নারী বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করে না। বয়স চল্লিশ পেরুলে, তাকে কোনো মদের দোকানে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। সে চায় কেউ তাকে একটু সময় দিক, কথা বলুক”।

কাজেই হতাশার কোনো কারণ নেই। যুবকদের উদ্দেশ্য করে বলবো, বিয়ে ভীতি দূর করুন। কখনো হতাশ হবেন না। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করুন। দু’আর আমল, দরুদ ও এস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চান। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আপনার জন্য উত্তম জোড়া তথা উত্তম জীবন সঙ্গীর ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের যুব সমাজকে হেফাজত করুন। তাদের আমল আখলাক, আকিদা আদর্শ ও চরিত্র ঠিক রেখে ঈমানের ওপর অটল ও অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলাম বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক

পারিবারিক জীবন নিয়ে জানতে আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button