Startup Story

ফেরিওয়ালা থেকে শ্রেষ্ঠ ধনী: ধীরুভাই আম্বানি

১৯৫৭ সালে ৫০০ টাকা নিয়ে মুম্বাই আসা ছেলেটি তার মৃত্যুর সময় ৭৫ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছিল। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানীকে তো আমরা সবাই চিনি কিন্তু আমরা কি জানি এই কোম্পানীর সফলতার পেছনের গল্পগুলো? আজকের এই আর্টিকেলে আলোচনা করবো ব্যর্থতার বিশাল পাহাড় পেড়িয়ে কীভাবে ধীরুভাই আম্বানি সফলতার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন এবং গড়েছিলেন সেসময়ে ভারতের সবচেয়ে বড় কোম্পানী

ধীরুভাই আম্বানির ছেলে বেলা

ধীরজলাল হীরাচন্দ অম্বানী যিনি ধীরুভাই নামেই খ্যাত। ধীরুভাই একজন ভারতীয় শিল্পপতি এবং ভারতের অন্যতম বড় কোম্পানী রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রতিষ্ঠাতা। সালটা ১৯৩২, কোনো মতে দিনপাত হয়, কখনো কখনো আবার সামান্য খরচ জোগানোর মতো টাকাও জোটে না। এরকমই এক দরীদ্র পরিবারে ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩২ সালে জন্ম।

কিশোর বয়সে ভাগ্যের সন্ধান

কিশোর বয়সে বাধ্য হয়েই বিস্কুট ফেরী করেছেন। এমনকি তেলের পাম্পে কাজও করেছেন। এরকমই একজন নিরীহ ছেলে যে মৃত্যুর সময় ৭৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রেখে যাবেন তা কি কেউ কল্পনা করেছিল! সবাই বলেন, বাবার সম্পত্তি না থাকলে নাকি খুব বেশি ধনী হওয়া সম্ভব না, কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল প্রমান করে, ধীরুভাই আম্বানি জিরো থেকে হয়েছেন হিরো । তাও আবার শুধুমাত্র নিজের দক্ষতা, বিচার শক্তি এবং ধৈর্য্যকে কাজে লাগিয়েই।

বিলগেটসের সেই বিখ্যাত উক্তিটা আবারো মনে পড়ে গেল-

বিল গেটসের ‍উক্তি

“If you are born poor it’s not your mistake, but if you die poor it’s your mistake.”

— বিল গেটস

পড়াশুনার সমাপ্তি ও কাজ শুরু

সংসারের অভাবের তাড়নায় এমন একটা সময় আসলো, যখন মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটাতে হলো এবং বাধ্য হয়েই পিতাকে সাহায্য করার জন্য প্রথমে ফলের ব্যবসা, এরপর বিস্কুটের ব্যবসা, তারপর তেলেভাজা ফাস্টফুডের ব্যবসা করেন। কিন্তু কিছুতেই সফলতা আসছিলোনা

ধীরুভাই আম্বানির দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো

অনেক অসফলতাই যে সফলতার সিঁড়ি তৈরি করে তা ধীরুভাই আম্বানির দিকে তাকালেই দেখা যাবে। বারংবার অসফলতার বেদনা তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এমতাবস্থায় তার বাবা তাঁকে চাকরি করার দিকে মনযোগ দিতে বললে একরকম বাধ্য হয়েই ইয়েমেনে থাকা বড় দাদার সাহায্যে তিনিও ইয়েমেনে পাড়ি জমান। মাত্র ৩০০ টাকা বেতনের এই কাজের মধ্য দিয়েই তাঁর কঠোর কর্মজীবনের শুরু। পেট্রোল পাম্পে গাড়িতে তেল ভরা আর টাকা সংগ্রহ করার কাজ করতে করতে তেল বাণিজ্যের বহু খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে ধারণার পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানও অর্জন করেন। কাজে নিষ্ঠার ফলে তিনি পদোন্নতি পেতে পেতে একসময় সেলস্‌ ম্যানেজারের পদে উন্নীত হন। তখন তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়ায় ১১০০ টাকা। কিন্তু ধীরুভাইয়ের মন যেন চাকরির দিকে নয় বরং ব্যবসার দিকেই বেশি টানে। মাথায় সবসময় ঘুরপাক খায় কিভাবে একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়া যায়।

ব্যবসায়ীদের আলোচনা শোনার জন্য নিয়মিত বেশি খরচে চা খাওয়া

ধীরুবভাই যে পাম্পে কাজ করতেন, সেখানে কর্মচারীদের চা-খাওয়ার জন্য প্রতিদিন ২৫ পয়সা করে দেওয়া হত। কিন্তু ধীরুভাই, পাশের একটি হোটেলে যেতেন চা-খেতে, যেখানে চায়ের দাম ১ টাকা। কিন্তু তা সত্যেও তিনি সেখানেই ৭৫ পয়সা বেশি খরচায় চা খেতে যেতেন কারণ- “সেখানে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আসেতেন এবং তারা ব্যবসা সংক্রান্ত নানান আলোচনা করেতেন, যা ধীরুভাই খেয়াল করে শুনতেন। ” হোটেলে চা খেতে খেতে ব্যবসায়ীদের আলোচনা ও নিজের বিচক্ষণাতার মাধ্যমে বুঝতে পারেন রূপার আকরিক থেকে খাঁটি রূপা নিষ্কাশন করে বাজারে বিক্রি করলে সেখান থেকে অনেক লাভবান হওয়া যাবে। এরপর সুযোগ বুঝে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে এককালীন প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ফেললেন, এটিই তার ধনকুবের হওয়ার প্রাথমিক ধাপ বলা যেতে পারে। কথায় আছে, কিছু পাওয়ার জন্য কিছু হারাতে হয়। ধীরুভাইয়ের হোটেলে বেশি টাকা দিয়ে চা-খাওয়ার গল্পটি যেন, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ধীরুভাই আম্বানির বিয়ে ও সন্তান

ইয়েমেনে কোকিলা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন এবং সেখানেই ১৯৫৭ সালে তাঁর বড় ছেলে মুকেশ আম্বানী ও ১৯৫৯ সালে ছোট ছেলে অনিল আম্বানীর জন্ম হয়। তাদের আরো দুই কন্যা সন্তান নিনা ও দীপ্তির জন্ম হয় ভারতে।

স্ত্রী: ককিলাবেন অম্বানী
ছেলে: মুকেশ আম্বানিঅনিল অম্বানী
মেয়ে: নিনা কথারীদীপ্তি সালগাওকার

একনজরে নিচের ছবিতে আম্বানী বংশধর

ধীরুভাই আম্বানির পরিবার
ধীরুভাই আম্বানী বংশ
image: wikipedia

ভারতে ফিরে আসা ও ব্যবসা শুরু

১৯৬২ সালে নিজস্ব বস্ত্রবয়ন শিল্প তৈরির স্বপ্ন নিয়ে ধীরুভাই ভারতে ফিরে আসেন। স্বপ্ন ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবসার যাতে তিনি প্রকৃত ধনী হতে পারেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার কাজে লগ্নি করতে উৎসাহিত করেন। এরপর খুড়তুতো ভাই চম্বকলাল দামানির সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাজিন’ (Magin) সংস্থা। কয়েক বছরের মধ্যেই ‘মাজিন’ সংস্থার বার্ষিক আয় প্রায় ৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। একত্রে অনেক পলিয়েস্টার সুতো মজুত করার ঝুঁকি নিতে চাইছিলেন ধীরুভাই। কিন্তু চম্বকলালের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৬৫ সালে ‘মাজিন’-এর অংশীদারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।

এর বছর খানেক পরে ধীরুভাই তৈরি করেন রিলায়েন্স গ্রুপ এবং বস্ত্রবয়ন বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৬ সালে গুজরাটের নারোদায় জমি কিনে ধীরুভাই প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিলায়েন্স কমার্শিয়াল কর্পোরেশন’ যা ১৯৭৩ সালে ‘রিলায়েন্স ইণ্ডাস্ট্রিজ’ নামে পরিচিতি পায়। এর পর একে একে টেলিযোগাযোগ, তৈল পরিশোধন, বিনোদন ক্ষেত্রেও ব্যবসায়িক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে রিলায়েন্স কর্পোরেশন যার মূল কাণ্ডারি ছিলেন ধীরুভাই আম্বানি।

ধীরু ভাই আম্বানির জীবনী থেকে শিক্ষা

ধীরু ভাই আম্বানীর জীবন কাহিনী থেকে যা যা আমরা শিখতে পারি চলুন সেগুলো একবার সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক

  1. লেখাপড়ার শেখা আর টাকা কামানোর মধ্যে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই।
  2. জীবনের যেকোন প্রবলেমকে প্রবলেম না বরং অপরচুনিটি হিসেবে দেখা উচিত।
  3. জীবনে কোন কিছু বড় করার ইচ্ছা থাকলে ক্যালকুলেটেড রিস্ক নিতে হবে।
ধীরুভাই আম্বানি

“যদি আপনি নিজে নিজের স্বপ্ন গড়ে তোলার কাজ না করেন, তাহলে অন্য কেউ আপনাকে তার তার স্বপ্ন গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করে নেবে।”

— ধীরুভাই আম্বানী

সবশেষে আপনার কাছে ছোট্ট একটা অনুরোধ – যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি নিজে অনুপ্রানিত হয়ে থাকেন তবে আপনার বন্ধু ও বান্ধবীদের সাথে শেয়ার করে তাদেরও অনুপ্রানিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।

ধীরুভাই আম্বানীর মৃত্যু

গুরুতর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কোমায় থাকতে থাকতে ২০০২ সালের ৬ জুলাই ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যু হয়। এই ধনকুবেরের মৃত্যু পুরো ভারত বর্ষকে শোকে আচ্ছন্ন করে তোলে।


সকল সফলতার গল্প পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button