ধূমপান ছাড়ার কার্যকর কৌশল
নেশা কি অদ্ভুত! ধূমপান করলে যে ফুসফুস নষ্ট হয়ে মানুষ মারায় যায় তা জেনেও মানুষ নিজেই নিজেকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। ধূমপানের করার কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার ও কার্যতারিতা একবারে কমে যায়। চাইলেও বেশিক্ষণ দম নেওয়া যায়না, হার্টের রক্তনালি শুকিয়ে চিকন হয় যা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অন্যতম কারণ। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে কমে যায় ফলে বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেতে থাকে। অনেক হতভাগা আছে যার ধুমপান নামক ঘাতককে চিরতরে নির্বাসনে দিতে চাই কিন্তু আর ছাড়া হয় না। ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে বছরে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মারা যায় এবং বিশ্বে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আফসোস তবুও মানুষের মতো দেখতে এই প্রাণিগুলো ধূমপান ছাড়তে রাজি না! অথচ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(তোমরা) নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)’
ধূমপান কি?
ধূমপান হচ্ছে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে ভাবা হয়।
ধূমপান কেন বড় নেশা এবং কেন ছাড়বেন
সমাজের অধিকাংশ ছেলেরা ধূমপান করে বলে এটি যে বড় নেশা তা মানতেই চান না। অথচ তাদের অধিকাংশই ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন নামক একটি কেমিক্যাল থাকে যা ধুমপানের নেশা সৃষ্টি করে। আমাদের শরীরের ভিতরে এক ধরণের হরমোন নিঃসরণ হয় যা শরীর সতেজ রাখে। ধূমপানের ফলে এই হরমোন নিঃসরণ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে তামাকের নিকোটিন এই হরমোনের কাজ করে। এজন্য হুট করে ধূমপান বন্ধ করলে অস্বস্তি লাগবে, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই, ধূমপান বন্ধ করার কিছু দিনের মধ্যেই আবার আগের মত স্বাভাবিক হরমোন নিঃসরণ হওয়া শুরু হয়।
ধূমপানের ক্ষতিকর দিক
তামাক বা নিকোটিন গ্রহণের কারণে আল্লাহর দেওয়া শরীরের প্রায় সব অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। ধূমপান করার কারণে ধমনিগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বেশ বাধাপ্রাপ্ত হয় যার ফলে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুও জায়গা মতো পৌঁছাতে পারেনা। এভাবে অল্প বয়সেই একজন মানুষকে বুড়ো বানিয়ে দেয়। তামাকে পাতায় থাকা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা ত্বকের কোলাজেন ও এলাস্টি ‘কে নষ্ট করে ত্বকে টসটসে ভাব মলিন করে চামড়া কুচকে যায়।
ধুমপান হারাম যে সব কারণে
১) ধুমপান করার ফলে শরীরে অনেক রোগব্যাধী হতে সাহায্য করে। তাছাড়া এটি স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক যা প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে। আর নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা তো ইসলামে নিষেধ রয়েছেই। “…নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না।” [বাকারা: ১৯৫]
২) ধুমপানের জন্য শরীরের কিছু অঙ্গ অকেজো হয়ে পড়ে যা নিজেই নিজেকে মরার দিকে নিয়ে যাওয়ার শামীল। আর এমনটি না করার জন্য পবিত্র কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে। “আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না।” [নিসা: ২৯]
৩) বেশিরভাগ ধুমপায়ী মানুষ নামের প্রাণিগুলো খোলা জায়গায়, লোকালয়ের মধ্যে, রাস্তায় ধুমপান করে যা অধূমপায়ীর জন্য খুবই বিরক্তিকর ও স্বাস্থ্যহানীর কারণ। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, “নিজের ক্ষতি স্বীকার করবেনা, অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা।” [হাদিস নং-৩২; মুয়াত্তা মালিক; হাদীসটির ইসনাদ সহীহ]
৪) পকেটের একটা ভালো অংক এর পিছনে অপচয় হয় যা ধর্ম অনুসারে উচিত নয়। “অপচয়কারী শয়তানের ভাই।”[সূরা ইসরা: ২৭]
৫) নিকোটিন মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় এটি দেহে প্রবেশ করানো ঠিক না।“…তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন যাবতীয় নাপাক ক্ষতিকারক বস্তুসমূহ।” [আরাফ: ১৫৭]
৬) জাহান্নামী খাদ্য খেলে যেমন পিপাসা বা ক্ষুধা নিবারণ হয় না তেমনি ধুমপান করার মধ্যেও সেই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা শরীরের কোন উপকার করেনা। “এটা তাদের পুষ্টিও যোগাবেনা ক্ষুদাও নিবারন করবেনা।“[সূরা আল-গাশিয়াহঃ ৭]
৭) তামাক নেশাগ্রস্থ মানুষের জন্য একটি নেশা জাতীয় পণ্য। কম হোক বা বেশী হোক সকল প্রকার নেশা দ্রব্য ইসলামে হারাম। [সূনানে ইবনে মাজাহ, ৩য় খন্ড, অধ্যায়ঃ ৩০, হাদীস নংঃ ৩৩৯২)
ধূমপান ছাড়ার কৌশল
১. চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা:
প্রথমে দৃঢ়ভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করুন আর সংকল্প করুন ।আপনি এখন এই আর্টিকেল পড়তে পড়তে এই মূহুর্ত থেকে চিরদিনের জন্য ধূমপান বন্ধ করাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন। কারণ এই ধূমপান আপনার স্থাস্থ্যহানীর সাথে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। আমি যতো ভালোই হন না কেন আপনি ধূমপান করলে আপনার ভালত্ব আর ভোলো থাকেনা। ছোট্ট এই জীবনে নিজের ক্ষতি করে সমাজের কাছেও কেন নিজেকে ছোট করবেন।
ধরে নিলাম আপনি ধূমপান ছাড়ার চিন্তা মাথায় ঢুকালেন এখন আপনার আশপাশে থাকা ধূমপান সংশ্লিষ্ট স্টিক, লাইটার, ছাইদানি (অ্যাশট্রে), সিগারেটের পুরোনো প্যাকেট সারাসরি সবার সামনে ডাস্টবিনে রেখে আসুন। সবার সামনে সরালে আপনার জন্য আরও বেশি সহজ হবে। সবার থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
২. ডায়েরিতে লিখে রাখুন:
ধূমপান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব, তা আপনার ডায়েরি বা অন্য কোথাও লিখে রাখুন। এতে আপনি আপনার কাছেই লিখিতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। এটি আপনাকে নিজের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বার বার মনে করিয়ে দেবে। এতে একসময় দেখা যাবে নিজের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনার আনন্দের উপলক্ষ্য হবে।
৩. ধূমপান করে না এমন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান: ধূমপান ছাড়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে যেসব বন্ধুরা ধূমপানে অভ্যস্ত না তাদের সঙ্গে চলাফেরা করা। প্রয়োজনে ধূমপান পছন্দ করেন না- এমন নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলুন। তার চাওয়া পাওয়াকে প্রাধান্য দিন।
৪. ধূমপান করা ব্যক্তি ও যে জায়গায় ধূমপান হয় সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান: নিকোটিনের আসক্তি দূর করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। প্রচুর পানি পান করলে দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর হতে সহজ হবে।
৬. গভীর শ্বাস: সফলভাবে ধূমপান ছাড়ার একটি উপায় হলো গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া। মনকে শান্ত করতে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার পদ্ধতিকে অনেক বিশেষজ্ঞই শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
৭. আদা: আদার মধ্যে উপস্থিত বেশ কিছু উপাদান নানাভাবে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে ধূমপান ছাডা়র কারণে যেসব উইথড্রল সিম্পটন দেখা দেয়, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়।
৮. মধু: এতে উপস্থিত বেশ কিছু ভিটামিন, এনজাইম এবং প্রোটিন শরীর থেকে নিকোটিন বের করে দেওয়ার পাশাপাশি সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে ধূমপান ছাড়তে কোনও অসুবিধাই হয় না।
৯. ভেষজ চা খান: নিকোটিন ছেড়ে দিলে প্রাথমিক অবস্থায় মানসিক দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে। ধূমপানের পরিবর্তে কফির ক্যাফেইন মানসিক দুশ্চিন্তাও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ভেষজ চা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
১০. হাটেঁন, দৌঁড়ান: দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাটেঁন, দৌঁড়ান অথবা সাইকেল চালান।
১১. সিগারেটের কথা মনে হলে চুইংগাম, লবঙ্গ, গাজর, শসা ইত্যাদি মুখে দেন।
১২. প্রিয়জনের কথা মনে করুন: আমরা সবাই ধূমপানের কুফল সম্পর্কে অবগত। যখন এর আসক্তি মাথায় চেপে বসে তখন প্রিয়জনদের কথা মনে করুন। মনে করুন প্রিয়জনদের সঙ্গেই আপনি সময় কাটাচ্ছেন। তাদের পাশেই আছেন।
১৩. ধৈর্য রাখুন, অটল থাকুন: দুই সপ্তাহ পার করতে পারলেই ধূমপান ছেড়ে দিতে পারবেন সারা জীবনের জন্য। তবে ভুলভ্রান্তির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, একবার ভুল করা মানেই আপনি ব্যর্থ নন। ভুল খুঁজে করুন এবং পরে একই ভুল থেকে সাবধান থাকুন।
আরও পড়ুন কোমল পানীয় কি সত্যই ‘কোমল’?